'ব' আসক্ত বাচ্চা
বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়েছি। কিছুদূর আসার পর পথিমধ্যে জ্যামে আটকে ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম ফুটপাতে দাঁড়ানো এক রমণী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েরা আমার দিকে তাকালে আমি আমার দুটো বিষয়ের প্রতি নজর দিই।
প্রথমত, আমার শার্টের বোতাম ঠিকঠাক মতো আছে কিনা দেখি আর দ্বিতীয়ত, আমার প্যান্টের চেইন ঠিক আছে কিনা দেখি।
এসব ছাড়া তাকানোর মতো আর কিছু নেই আমার।
খেয়াল করে দেখলাম দুটোই ঠিক আছে। এরপর রমণীর দিকে তাকালাম। এখনও তাকিয়ে আছে। কোলে একটা বাচ্চাও আছে। সুন্দরী নারী কোলে বাচ্চা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সুখ এবং কষ্ট দুটোই অনুভূত হচ্ছে। হঠাৎ রমণী আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করল।
মলম পার্টি না তো! ইদানীং নাকি মলম পার্টি সুন্দরী নারীদের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
আমি আস্তে করে আমার নাম বললাম। নাম শোনা মাত্র সে আমাকে বলল," আমাকে চিনেছিস? আমি সম্পা।"
কোন সম্পা? স্মৃতি ঘাঁটলাম। কিন্তু মনে পড়ছে না। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। সেটা বুঝতে পেরে সে আবার বলল," মনে নেই স্কুলে থাকার সময় একসাথে কোচিং এ পড়তাম আমরা?"
এবার মনে পড়েছে। আমাদের কোচিং এর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল সে। অনেক ছেলে ওর সাথে কথা বলার জন্য পাগল ছিল তখন। সেই পাগলের লিস্টে আমার নামও কয়েকদিন ছিল। দু-একদিন কথাও বলেছিলাম। পরে কি বুঝে কথা বলিনি সেটা মনে পড়ছে না আর। তাছাড়া তখন তুমি করে বলতাম। এখন ডাইরেক্ট তুই করে বলেছে সে আমাকে।
ব্যাপার না।
আমাকেও তুই করে বলতে হবে তাহলে।
তাকে বললাম," আচ্ছা এতক্ষণে চিনেছি। অনেক বছর পর দেখলাম। এখানে কি করিস তুই। কোলে এটা কে?"
স্মিত হেসে সে উত্তর দিল," এটা আমার বাচ্চা। তোর দুলাভাই গাড়ি নিয়ে আসবে বলেছে সেই পাঁচটায়। এখন পাঁচটা চল্লিশ বাজে। জ্যামে আটকে আছে নাকি।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম "কই যাবি?"
সে ঠিকানা বলল। আমিও সেদিকে যাচ্ছিলাম। তাকে বললাম," রিক্সায় উঠ। আমিও ওদিকে যাচ্ছি। "
এদিকে জ্যাম শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। রিক্সাওয়ালা রিক্সা সাইড করে আমাদের কথা শুনছিলেন। সম্পা বাচ্চাসহ রিক্সায় উঠার পর উনাকে বললাম "চলেন।"
রিক্সা চলছে।
সম্পাকে জিজ্ঞেস করলাম," তোর বাচ্চা কথা বলতে পারে?"
সম্পা বলল," হালকা হালকা পারে। অতো ভালো না।"
আমাকে দেখিয়ে সম্পা তার বাচ্চাকে বলল," বাবু এটা তোমার মামা। মামা ডাকো তো।"
বাচ্চা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কিছু বলল না। আমাকে হয়ত ভালো লাগে নি। সম্পা আবার বলল," বাবু মামাকে ডাকো তো।"
এবার বাবু মুখ খুলল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,"বাবা।"
ছোটবাবু ভুল করতেই পারে । তাকে তার মা শুধরে দিল, "বাবা নয় বাবু মামা বলো।"
কিন্তু ছেলে তো মামা বলে না। "বাবা" "বাবা" করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে বিষয়টা নিয়ে অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। কোনোমতে তাদেরকে তাদের গন্তব্যস্থানে নামিয়ে দিলাম। নামার সময় সম্পা তার বাসার ঠিকানা দিল। একটা কার্ড এবং তার নাম্বার ধরিয়ে দিল। আগামী পরশু তার বাচ্চার বার্থডে। আমি যেন অবশ্যই যাই। আমি আসবো বলে সম্পাকে বিদায় দিলাম।
বার্থ ডে এর দিন টাইমমতো পৌঁছে গেলাম। গিয়ে সম্পার সাথে দেখা করলাম। গিফট নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা সম্পাকে দিলাম। আমাকে দেখে সম্পা খুশি হলো। ওর স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বাচ্চাটা উনার কোলেই ছিল। আমি ওকে টেনে কোলে নিলাম।
এরপর ভয়ে ভয়ে বললাম, " কেমন আছো মামা?"
বাচ্চা লাফিয়ে আমার কোলে আসলো এবং যা আশংকা করলাম তাই ঘটল। সেদিনের মতো বাচ্চা বলে উঠল," বাবা।"
সম্পার স্বামীকে একটু বিচলিত মনে হল। আমি বাচ্চাটা উনার কোলে তুলে দিয়ে কেটে পড়তে চাইলাম। কিন্তু বাচ্চা আমাকে সেই সুযোগ দিল না। সে "বাবা" "বাবা" বলে কান্না করতে লাগল। সবাই প্রথমে বুঝতে পারেনি বিষয়টা। কিন্তু যখন খেয়াল করল বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করছে তখন সেখানে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল।
আমি আস্তে আস্তে সবার সামনে থেকে সরে গেলাম।
তাড়াতাড়ি রিক্সা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশিক্ষণ থাকলে কিলঘুষি একটাও মাটিতে পড়ত না। যা মাটিতে পড়ত তা কুড়িয়ে নিয়ে আবার আমার পিঠে তুলে দেওয়া হতো।
বাসায় এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আর জীবনেও ওই বাচ্চার সামনে যাবো না। আমাকে কোন আ্যঙ্গেল থেকে তার বাবার মতো মনে হয় সেটা খোদা মালুম।
বাসায় ঢুকার ২০ মিনিট পর সম্পা কল দিল। রিসিভ করব কি করব না সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে প্রথম কলটা ধরতে পারলাম না। সাথে সাথে আবার কল দিল।
ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে বললাম," হ্যালো।"
ওইপাশ থেকে সম্পা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল," কোথায় তুই? তোর জন্য আমার স্বামী মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। "
আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম," কি হয়েছে? কোথায় এখন তোরা?"
কি হয়েছে সেটা বলল না সম্পা। ক্লিনিকের ঠিকানা দিয়ে ফোন কেটে দিল। আমি ভাবতে লাগলাম কেন সেদিন পুরোনো বিবাহিত বান্ধবীকে লিফট দিতে গিয়েছিলাম? না দিলে এই অবিবাহিত বয়সে বাচ্চার মুখে বাবা ডাক শুনতে হতো না আমাকে। এতো ঝামেলায়ও পড়তে হতো না।
তাড়াতাড়ি আবার ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে বের হলাম।
গিয়ে দেখি সেখানে হুলস্থুল কাণ্ড। ৩০-৪০ জন মানুষ একসাথে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। কেউ বিলাপ করছে। কেউবা কানাঘুষা করছে। আমাকে দেখামাত্র সম্পা দৌড়ে এল। কান্না করতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে?"
সে আমাকে যা বলল তা সংক্ষেপে হল," আমি চলে আসার পর নাকি সম্পা এর বাচ্চা 'বাবা' 'বাবা' বলে আমাকে খুঁজছিল। সেটা তার স্বামীর কাছে ভালো লাগে নি। তাই তিনি সম্পাকে একপাশে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সম্পার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? যে ছেলে নিজের বাবাকে অতবার বাবা ডাকে নি সেই ছেলে অল্প পরিচিত একজনকে কেন এতবার বাবা ডাকছে? সম্পা এতে রেগে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে বসে ওর স্বামীকে।
সম্পা কোনোদিন ওর স্বামীকে উল্টাপাল্টা কথা বলেনি এবং নিজের ছেলে অন্যকে বাবা ডাকছে এই দুটো কারণে তিনি রেগে গিয়ে সম্পাকে মারতে উঠেছিলেন। কিন্তু মারার আগেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। এরপর তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে আনা হয়। এখনও জ্ঞান ফিরেনি।"
সম্পাকে কি বলব ভাবছি। সম্পার বাচ্চাটার দিকে হঠাৎ চোখ গেল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পরিবারে বিশ্বযুদ্ধ চলছে আর ব্যাটা হাসছে।
রেগে গিয়ে সম্পাকে বললাম," যত সমস্যা তোর এই বাচ্চার। আমাকে তখন থেকে বাবা ডাকছে কেন? ওকে জিজ্ঞেস কর।"
সম্পা চুপ করে রইল।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বললাম," মামা বলো তো।"
সে বলে," বাবা।"
এরপর বললাম, "মা বলো তো।"
ও চুপ করে রইল। আরেকবার আদর করে বললাম। এবার বাচ্চা বলল, " বা।"
আমি আবার বললাম," আম বলো তো।"
বাচ্চা বলল," আব।"
সম্পাকে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলাম। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকালো আমার দিকে।
সম্পা দৌড়ে আসলো।
জিজ্ঞেস করল আমাকে," কি হয়েছে?"
আমি রেগে বললাম," তোর বাচ্চা ম এর জায়গায় ব উচ্চারণ করে এটা জানিস না!"
সম্পা পরীক্ষা করে দেখল। ঘটনা সত্যি। পুরো বারান্দা জুড়ে আমি স্বস্তির নিশ্বাস পেলাম। এমন সময় ডাক্তার এসে জানালো লোপার স্বামী এখন আশংকামুক্ত। আমি আবার সবাইকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুনলাম।
নিজেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাইরে আসার জন্য পা দিলাম।
এমন সময় পিছন থেকে হালকা ডাক শুনলাম, "বা-বা.... বাবা।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন